পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার বা সোমপুর বিহার
বাংলাদেশের আরেকটি ঐতিহ্যবাহী জায়গার
নাম হল পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার
বা সোমপুর বিহার বা সোমপুর মহাবিহার।এটি বাংলার অতি প্রাচীন সৃতিস্তম্ভ যা বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার।ইতিহাসের সাক্ষী
হয়ে দাড়িয়ে আছে এই সোমপুর বিহার।এটি রাজশাহী বিভাগের নওগাঁ জেলায় অবস্থিত।তত্ত্ব অনুসন্ধান করে জানা যায় যে পালবংশের দ্বিতীয়
রাজা শ্রী ধর্মপালদেব অষ্টম শতকের শেষের দিকে বা নবম শতকে এই বিহার তৈরি করছিলেন।পরবর্তীতে
১৮৭৯ সালে স্যার কানিংহাম এই বিশাল কীর্তি আবিষ্কার করেন।এরপর ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো
এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদা দেয়। পাহাড়পুরকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড়
বৌদ্ধবিহার বলা যেতে পারে। আয়তনের দিক বিবেচনা করলে দেখা যায় এর সাথে ভারতের
নালন্দা মহাবিহারের তুলনা হতে পারে।
এই বিহার সম্পর্কে আরও যানা যায় যে
এটি প্রায় ৩০০ বছর ধরে বৌদ্ধদের অতি বিখ্যাত ধর্মচর্চা কেন্দ্র ছিল।আবার এটি
শুধু ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকেই নয়, চীন, তিব্বত, মায়ানমার (তদানীন্তন
ব্রহ্মদেশ), মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশের বৌদ্ধরা এখানে ধর্মচর্চা ও ধর্মজ্ঞান অর্জন করতে
আসতেন বলে জানা যায়।খ্রিষ্টীয় দশম শতকে বিহারের আচার্য ছিলে মূলত অতীশ দীপঙ্কর
শ্রীজ্ঞান।
৭ম শতাব্দীর মাঝামাঝিতে হিউয়েন ৎসাং পুন্ড্রবর্ধনে আসেন ও তার বিস্তারিত
বিবরণে সোমপুরের বিহার ও মন্দিরের কোন উল্লেখ নেই। গোপালের পুত্র ধর্মপাল (৭৮১ -
৮২২ খ্রি) সিংহাসনে আরোহণ করে দীর্ঘকাল রাজত্ব করেন ও রাজ্যকে বাংলা বিহার
ছাড়িয়ে পাকিস্তানের উত্তর - পশ্চিম সীমান্তের গান্ধার পর্যন্ত বিস্তৃত করেন।
সম্রাট ধর্মপাল অনেক নিষ্ঠাবান বৌদ্ধ ছিলেন বলে শোনা যেত।এছারও তিনি বিক্রমশীলা ও
সোমপুর বিহার প্রতিষ্ঠা করেন। অন্য মতে, বিখ্যাত তিব্বতীয় ইতিহাস গ্রন্থ "পাগ সাম জোন ঝাং" এর লেখক অত্যন্ত
সুস্পষ্টভাবে ধর্মপালের পুত্র দেবপাল (৮১০-৮৫০)কর্তৃক সোমপুরে নির্মিত বিশাল বিহার
ও সুউচ্চ মন্দিরের উল্লেখ করেছেন। সোমপুর বিহারের ভিক্ষুরা নালন্দা, বুদ্ধগয়া প্রভৃতি ভারতীয়
বিভিন্ন বৌদ্ধ তীর্থস্থানে অর্থ ও ধন রত্ন দান করতেন বলে বিভিন্ন লিপিতে উল্লেখ
করা আছে যা ১০ - ১১শ শতাব্দীতে সমৃদ্ধশীল অবস্থার ইঙ্গিত বহন করে থাকে।
এছাড়া ৯ম
শতাব্দী পর্যন্ত পাল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় সোমপুর বিহার ছাড়াও অগ্রপুর (রাজশাহীর
অগ্রাদিগুণ), উষ্মপুর, গোটপুর, এতপুর ও জগদ্দল (
রাজশাহীর জগদল) বিহারের উল্লেখ পাওয়া যায়। ৯ম শতাব্দীর শেষভাগে গুর্জর রাজ প্রথম
ভোজ ও মহেন্দ্র পাল, পাল সাম্রাজ্যের বিশেষ
ক্ষতিসাধন করেন। পরে ১০ম শতাব্দীর শেষভাগে পাল বংশীয় রাজা মহীপাল (৯৯৫ - ১০৪৩)
সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার করেন ও সোমপুর বিহার মেরামত করেন। কিন্তু মহীপাল ও তার পুত্র
নয়াপালের মৃত্যুর পর আবার পাল বংশের পতন শুরু হয়েছিল বলে জানা যায়।এই সুযোগে
মধ্যভারতের চেদীরাজ কর্ণ,
চোলরায রাজেন্দ্র ও দিব্বো নামের এক দেশীয় কৈবর্ত সামন্ত নরপতি পর পর
বরেন্দ্রভূমি আক্রমণ করেন।যার ফলে পরবরতিতে ধারনা করা হয় যে নালন্দায় পাহাড়পুর
মন্দির ও বিহার ধ্বংসের উল্লেখ সম্ভবত এ সময়ের আক্রমণের কারনেই হয়েছিল।
একাদশ
শতাব্দীতে পাল বংশীয় রামপাল হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধার করেন।পরে দ্বাদশ শতাব্দীতে
দাক্ষিণাত্যের কর্ণাট থেকে আগত সেন রাজারা বাংলা দখল করেন। তাদের নিকটে রাজকীয়
পৃষ্ঠপোষকতা হারিয়ে ফেলে সোমপুর বিহার।আর এ সময়েই শেষবারের মত সোমপুরের পতন শুরু
হয় বলে জানা যায়।এর পরে ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুতে ইখতিয়ারউদ্দিন মুহম্মদ -বিন -বখতিয়ার
খিলজী বাংলায় আক্রমণ করে প্রায় উত্তরবঙ্গই দখল করেন।ফলে এসব এলাকাসহ এর আশেপাশের
অধিকাংশ এলাকাই মুসলমানদের দখলে চলে যায়।তারা এসব ধর্মের নামে মূর্তি পুজার বিরোধী
ছিল।ধর্মীয় আদর্শগত ব্যাপক পার্থক্য বিদ্যমান ছিল দুই পক্ষের শাসকদের মধ্যে। সম্ভবত
মুসলমান শাসকদের মূর্তিবিরোধী এই মনোভাবের কারনেই পরবর্তীতে বৌদ্ধদের এই বিহার ও
মন্দির সম্পূর্ণ রূপে ধ্বংস হয়ে যায়।
বাংলার
ইতিহাসে এই সোমপুর বিহার আলাদা ঐতিহ্য বহন করে থাকে।এর সাথে মিশে আছে পূর্বের
শাসকদের অতীত ইতিহাস, তাদের জীবনযাপন, ক্ষমতার উথান পতন ইত্যাদি। শুধু ঐতিহসিক নয়
বাংলার মানুষের কাছে এটি একটি দর্শনীয় জায়গা বলে পরিচিত।প্রতিদিন অনেক দর্শনার্থী
ভীর জামায় প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী এই সৃতিস্তম্ভটি দেখার জন্য।
পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার বা সোমপুর বিহার এর একাংশ